চট্টগ্রামের স্বন্দীপে জন্ম নেয়া লেখক ও শিক্ষক ফারজানা মাহবুব। উচ্চবংশীয় ও উচ্চশিক্ষিতা এই নারী দীর্ঘদিন থেকে লেখালেখি করলেও ‘শরাহত পাখি’ ই তাঁর প্রকাশিত ১ম গল্প গ্রন্থ। চট্টগ্রাম সাহিত্য পরিষদ থেকে কাজী হক এর চমৎকার প্রচ্ছদে বইটি প্রকাশ করেছেন মাহবুবুল মাওলা রিপন। ৮০ গ্রাম অপসেট ও রঙ্গিন উন্নত বোর্ড বাঁধাই এর উক্ত বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ১২০/- টাকা। ঢাকা ও চট্টগ্রামের অনেকগুলা প্রতিষ্ঠান পরিবেশক এর পাশাপাশি অনলাইনে রকমারী ডটকমও বইটি বিক্রি করছে। বইটিতে বাস্তব জীবনধর্মী মোট ৯ টি গল্প স্থান পেয়েছে যেমন- আশ্রিতা, অপেক্ষা, শরাহত পাখি, হারানো মানিক, বাগদান, বন্ধন, ভালোবাসার মূল্য, মিথুন ও বোধ।
বইয়ের তৃতীয় গল্প এই বইয়ের নাম গল্প ‘শরাহত পাখি’ । এই গল্পে সৈকত তার হারানো মায়ের খুঁঁজে গ্রামীন এলাকায় ঘুরতে থাকে। সাথে আছে তার পিতা ও সৎ মা। কোনোভাবেই খুঁজ না পেলেও তার মা যে মানসিক রুগি ছিলো সেটার প্রমান পেয়ে যায়। তার মাকে পাগলীনি ডাকতো সবাই। শেষ পর্যন্ত সৈকত সিদ্ধান্ত নেয় এই এলাকায় একটি মানসিক হাসপাতাল করবে। ঠিক এই জায়গায় গল্পকার ফারজানা মাহবুবের দূরদর্শিতার প্রমান পাওয়া যায়। যেমন- হয়ত কোনো একদিন তার পাগলীনি মা চিকিৎসার জন্য হলেও হাসপাতালে কেও নিয়ে আসতে পাওে, আর না হয় সৈকত হাসপাতালের সকল রুগিকে নিজের মায়ের মত করে সেবা দিবে মা’কে মনে করে।
আমরা সবগুলা গল্প থেকে চৌম্বক অংশগুলো নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করব। বইয়ের শুরুতেই রয়েছে ছোটগল্প ‘আশ্রিতা। আপনি যখন আশ্রিতা গল্পটি পড়বেন তখন ত্রিমুখী কঠিন চিন্তার উপলব্ধি হবেই। এক. রাহেলা তার মারা যাওয়া সতীনের পাঁচ সন্তানকে লালন পালন করে বড় করেছে নিজ সন্তানের মত। নিজে কোন সন্তান জন্মদান করতে না পারলেও মাতৃত্বের দু:খ ভুলে যায়। দুই. বাসর রাতে যখন এয়াকুব সাহেব দেখলেন নতুন ও দ্বিতীয় বউ রাহেলা তার আগের সংসারের ছোট ছোট পাঁচ সন্তানকে বুকে আগলে রেখে ঘুমাচ্ছে তখন আনন্দে তার মনটা ভরে যায়। সাথে সাথে ভয় তৈরি হয় রাহেলার ঘরে সন্তান জন্ম নেয়ার পর কি এই ভালোবাসা বলবৎ থাকবে? তিন. শেষ পর্যন্ত সন্তানরা বড় হয়, আমেরিকা কানাডা বাস করে, কিন্তু এয়াকুব সাহেব এর মৃত্যুর পর রাহেলাকে সৎ মা ও মনে করতে নারাজ! এই কঠিন তিনটি সমীকরন আপনার ভাবের হৃদয়ে ঢেউ তুলবে। আপনি এয়াকুব এর দূর্বল চিন্তায় রাহেলার পেঠের সন্তান বন্ধ করার জন্য হলেও রাহেলার প্রতি ভালোবাসার সৃষ্টি হতেই পারে। একটা নারী শেষ পর্যন্ত হয়ে যায়- একজন সফল জীবন যোদ্ধা, সন্তান লালনকারী, সংসার এর পাল ধরা মাঝি এবং সেই সংসার হতে প্রাপ্ত একটা কঠিন তীরের আঘাতে জর্জরিত বুকের কলংকীনি।
বইয়ের দ্বিতীয় ‘অপেক্ষা’ গল্পে নিলা তার স্বামীর দূর্ব্যবহারে অতিষ্ট হয়েও যে চিন্তা-টা করেছে তা সমাজকে দারুনভাবে বার্তা দেয়। যেমন- নিলা ভাবলো সে মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। তার উপর আছে ছোট বোন দুইটা ঘরে। বিয়ের মাত্র এক বছরের মাথায় সে তালাকপ্রাপ্ত হলে সেই দু’টি বোনের উপর চরমভাবে প্রভাব ফেলবে। নিজের এতো অত্যাচারের মাঝে থেকেও চিন্তা করেছে বোনদের কথা। তাইতো সে চ্যালেঞ্জ নিয়েছে স্বামীর সব অত্যাচার সহ্য করবে। সর্বোচ্চ ভালোবাসা দিয়ে স্বামীর মন জয় করবেই। তার এই সংগ্রামে তাহাজ্জুদে জায়নামাজে বসে হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার সাহায্য কামনা লেখকের জ্ঞানগর্ভের বিষয়। লেখক একজন নারী হয়ে একটি যুবতী মেয়ের বর্তমান অবস্থাটা অত্যান্ত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
‘হারানো মানিক’ বইয়ের চতুর্থ গল্প। সুরভী, আহনাফ, লাবনীর ত্রিমুখী প্রেম। সম্পূর্ণ বৈধ অথচ কঠিন সমীকরন। সাইফের মত হেল্পিং মাইন্ড বন্ধু আছে বলেই পৃথিবীতে এখনও বন্ধুত্ব বেঁচে রয়। আরমান যদি লঞ্চ ডুবিতে মারা যেত হয়ত ভালো ছিলো। কিন্তু মানব সভ্যতার ইতিহাসে কত কঠিন বাস্তবতার ইতিহাস পরিলক্ষিত হয় যুগে যুগে। এক্ষেত্রে গল্পকার ফারজানা মাহবুব আরমানকে বাঁচিয়ে রেখে চমৎকার ভাবে যে করুন ট্রাজেডির জন্ম দিয়েছেন তা প্রশংসার দাবি রাখে লেখক হিসাবে।
পঞ্চম গল্প ‘বাগদান’। লেখক তার সবগুলো ছোটগল্পকে বেশ জঠিল কাহিনীতে প্যারাডক্স টাইপের উপস্থাপন করেছেন দক্ষ হাতে। বাগদান গল্পে আফরিনার হাসিবের কাছে স্ত্রী এর জায়গায় অবমূল্যায়ন সহ প্রত্যাখান হলেও জীবন যুদ্ধে সোহানকে স্বামী হিসেবে গ্রহন। যেই আমেরিকা প্রবাসী হাসিবের সাথে থাকতে পারলনা ভাগ্যের কি পরিহাস সেই আমেরিকা থেকেই স্বামী সন্তান নিয়ে দেশে আসছে আজ পাঁচ বছর পর।
বন্ধন গল্পে সবোর্চ্চ পর্যায় অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে প্রতিষ্টিত করার প্রয়াস। মুসলিম আফিয়া খাতুনের জন্য হিন্দু সুষমার ঘর। হিন্দু সুষমার জন্য মুসলিম আফিয়া অভিবাবক ইত্যাদি। লেডিস ক্লাবে গমনে অত্যাধুনকি নারী সমাজের খারাপ দিকটাও ফুঠে উঠেছে বইয়ের ছয় নং এই গল্পে।
বইয়ের অষ্টম গল্পে মিথুন ও তার বাবার ঘটনাগুলো আপনাকে আবেগী কওে তুলতে পারে। পাশের বিল্ডিং এর মিষ্টি আপুর স্বাক্ষী থাকা ও দু:খের বন্ধু হওয়াটা শুভ লক্ষণ। ‘ভালোবাসার মূল্য’ গল্পে সজীব মোহনার যৌতুকের জন্য বলিদান কষ্টকর। এক্ষেত্রে সজীবরে চিরকুট বেদনাদায়ক। বইয়ের শেষ ‘বোধ’ গল্পে হরিপদ বাবু, বিমলা দেবী ও বিমলের ঘটনাগুলো দু:খের ট্রাজেডি হয়ে বয়ে যাবে পাঠকের মনে।
লেখক ফারজানা মাহবুবের প্রথম গল্পগ্রন্থ হিসাবে উপস্থাপনা অত্যান্ত চমৎকার হয়েছে। এরপরও পৃথিবীর সকল কাজেই কিছু না কিছুু ত্রুটি থাকেই। যেমন- যথেষ্ট উপকরন থাকার পরেও লেখক কিছু গল্প-কে আরো খানিকটা লম্বা করতে পারতেন। ২/১ টা গল্পে রবীন্দ্রনাথের ‘শেষ হয়েও হইলনা শেষ’ কথার স্বার্থকতার জন্য আরেকটু যতœশীল হতে হবে ইত্যাদি। তদোপরি ‘শরাহত পাখি’ বইয়ের মোট নয়টি গল্প গল্পকার হিসাবে লেখককে অন্য এক ভূবনে জায়গা করে দিবে। অনার্স মাষ্টার্স সহ বিএড করা গল্পকার ফারজানা মাহবুব শুরুতে ফারজানা জেসমিন সুইটি নামে বড় হয়েছেন। বিয়ের পর থেকেই মূলত ফারজানা মাহবুব নাম ধারন করেন। স্বামী, তিন মেয়ে দুই ছেলের সুখী সয়সারের দায়িত্ব পালনের পরও লেখালেখিতে যে শুভ সুচনা করলেন ‘শরাহত পাখি’ গল্প গ্রন্থের মাধ্যমে তা বর্তমান নারী জাগরন ও নারীদের এগিয়ে যাওয়ার মিছিলে সফল নারী লেখক হিসাবে তাঁকে স্থান করে দিবে। গল্পকার ফারজানা মাহবুব এর প্রকাশিত প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘শরাহত পাখি’ বইয়ের বহুল প্রচার কামনা করি।
লেখক: আজমল আহমদ, কবি ও প্রাবন্ধিক, 13.12.2020 সিলেট।।